বাঙালিয়ানা : স্বরূপ অন্বেষণে

Bangaliyana

বাঙালিয়ানা : স্বরূপ অন্বেষণে

আহমেদ ফিরোজ

বাঙালিয়ানা

বাংলা, বাঙালি, বাঙালিয়ানা—পরস্পর বেড়ে ওঠা শব্দসম্ভার এবং ধর্ম-বর্ণ, জাতি নির্বিশেষে এতদঞ্চলের মানুষের হয়ে ওঠার ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত। বাংলা, বাঙলা, বাঙ্গালা—বঙ্গদেশ, বঙ্গভাষা। বাঙালি—বাংলাদেশের মানুষের জাতি সত্তা এবং বাংলাভাষী, বাংলাদেশী। বাঙালিয়ানা—বাংলা ও বাঙালির স্বরূপ অন্বেষণের পূর্বপথ, স্বপ্নযাত্রার শুরু এবং স্বপ্ন-সম্ভব সম্ভাবনার ইতিহাস।

এককথায় বাঙালির আচরণগত বৈশিষ্ট্যই বাঙালিয়ানা। এই বৈশিষ্ট্যের স্বরূপ অন্বেষণের ধারায় বাঙালির নৃতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের মাঝেই বাঙালিয়ানার প্রকাশ।

বিশ্বের প্রত্যেক জাতির জীবনধারায়, অর্থাৎ তাদের আচার-ব্যবহার, খাওয়া-দাওয়া, চলা-ফেরা, পোশাক-পরিচ্ছদ থেকে শুরু করে তাদের সংস্কৃতি বলতে যা-কিছু বোঝায়—তার কতকগুলো বৈশিষ্ট্য আর দোষ-গুণ থাকে। বাঙালিদের জীবনযাত্রার ও সংস্কৃতির এই বিশেষ চেহারা, মেজাজ আর গুণাগুণগুলোকেই বাঙালিয়ানা হিসাবে ধরা হয়।

মোদ্দাকথা, বাঙালিয়ানা বাঙালির সাংস্কৃতিক উপস্থাপনা ও তার ঐতিহ্য-বৈশিষ্ট্য। সাংস্কৃতিক ধারার মধ্যে বাঙালির সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ভৌগলিক, ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণসহ শিল্প-সাহিত্য-শিক্ষার গুরুত্ব অগ্রগণ্য। এইসব বিবেচনায় বাঙালিয়ানা তার স্বরূপে উদ্ঘাটিত ও প্রকাশিত।

বাঙালির আচরণগত বৈশিষ্ট্যও বাঙালিয়ানার অন্তর্ভুক্ত। তবে এর নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ মানুষের সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিল্প-শিক্ষা, রাজনীতি-অর্থনীতি—এই জীবনকে তাড়িত করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে মন, শরীর ও আত্মার অবস্থান—ইচ্ছা, শ্রম ও সাধনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও বিকশিত। এইসব চর্চা মানুষের মনস্তাত্ত্বিক ও বাহ্যিক জীবন-প্রবাহকে এগিয়ে দেয়। জীবনকে করে সম্পন্ন। মানুষের এই নানা মাত্রিক বেড়ে ওঠা বাঙালির জীবনেও বর্তমান। এই বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যতের ভাবনা ও কর্মই বাঙালিয়ানা।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘বাঙালির কোনো ইতিহাস নেই, কে লিখিবে বাঙালির ইতিহাস, আমি লিখিব, তুমি লিখিবে—যে বাঙালি সেই লিখিবে।’ আধুনিক বাংলা উপন্যাসের জনক বাঙালি সম্পর্কে এ-কথা বললেও, আমরা বাঙালির যে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, অর্জন ও অবদানের সাথে বাঙালির গোটা পরিচয় তুলে ধরতে চাই—তা সবসময় আদর্শ-স্থানীয় না-হলেও, সেখানে আশার আলো দেদীপ্যমান।

বাঙালি ও বাঙালিয়ানার বিভিন্ন স্তরসমূহ বিশ্লেষণে তার রূপটি আরো পরিষ্কার হয়ে উঠবে।

নৃতাত্ত্বিক

বাঙালির কোনো একক জাতিসত্তার পরিচয় নেই। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর উত্তরাধিকারের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে বাঙালির নৃতাত্ত্বিক সত্ত্বা। সময়ের বিবর্তনের ধারায় বাঙালির জাতি-পরিচয়ে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন মাত্রা। এভাবে বাঙালির জাতি-পরিচয় যুগে যুগে সমৃদ্ধ হয়েছে এবং এ-ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। বিভিন্ন জাতির বিচিত্র বৈশিষ্ট্য আহরণ করে একটি আত্মপরিচয় সম্পন্ন জাতি হয়ে ওঠার মধ্যে রয়েছে বাঙালির নৃতাত্ত্বিক স্বাতন্ত্র্য।

ঐতিহাসিক

শাসক জাতি নয়, শাসিত; বিশ্বাসঘাতক, আজ্ঞাবহ, মেরুদণ্ডহীন জাতি বাঙালি। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা লাভের পূর্বপর্যন্ত বাঙালি বিদেশিদের হাতে শাসিত হয়েছে, কখনো স্বশাসন অর্জন করতে পারেনি। তুর্কি-পাঠান-মোঘল-ইংরেজ এবং সর্বশেষ পাকিস্তানিদের দ্বারা শাসিত হয়েছে বাঙালি। পরাধীনতা ঘুচাতে বারবার চেষ্টা করেও নিজেদের বিশ্বাসঘাতকতা, বিদেশি প্রভুদের সেবা মানসিকতা এবং জাতি হিসেবে আত্মসম্মানবোধের অভাব চূড়ান্ত সফলতার পথকে বিঘ্নিত করেছে।

সামাজিক

সামষ্টিকতা, সহনশীলতা ও সমন্বয়ধর্মিতা বাঙালির সামাজিক আদর্শ। এই আদর্শ বাঙালির সমাজজীবনে তার দীর্ঘদিনের লালিত কিছু অভ্যাস, গুণাবলী এবং বৈশিষ্ট্যের মাঝে গড়ে উঠেছে। এই বৈশিষ্ট্যের স্বরূপ অন্বেষণ করলে আমরা দেখতে পাই, বাঙালি তার ঐতিহ্যবিমুখতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কূপমণ্ডুকতা, কুসংস্কার, পশ্চাৎপদতা অথচ একই সঙ্গে বিদ্যুৎসাহী ও বিশাল রোমান্টিক মনের অধিকারী হয়ে হাজার বছরের সামাজিকজীবনে নিজের এক স্বকীয় আসন গড়তে পেরেছে।

রাজনৈতিক

বাঙালি সঠিক ও উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে কখনোই সুসংহত জাতি হিসেবে তার রাজনৈতিক পরিচয় তৈরি করতে পারেনি। বিশ্বাসঘাতকতা, ক্ষমতালিপ্সা, ব্যক্তিপূজা, নেতৃত্বের প্রতি আস্থাহীনতা, ষড়যন্ত্রী, ভীরু অথচ উচ্চাকাঙ্ক্ষী চরিত্র বাঙালির রাজনৈতিকজীবনকে বারবার বিঘ্নিত ও বিপর্যস্ত করেছে।

সাংস্কৃতিক

বাঙালির বাঙালিয়ানা-মন বহু বছরের সংসারে নিখাদভাবে তৈরি হয়েছে। যে-মন একাধারে রোমান্টিক, ভাবুক, ভবঘুরে, ত্যাগী, সন্তান বাৎসল্যে উদ্বেলিত, রাগী, পরশ্রীকাতর, অদূরদর্শী, নিয়ত স্ববিরোধী, অমিতব্যয়ী, কপট শিল্পানুরাগী, কিন্তু ভীষণ অতিথিপরায়ণ এবং চূড়ান্ত বিচারে নির্ভেজাল পারিবারিক জীব।

এই যে বাঙালিয়ানা, বাঙালির পরিচয় ও আচরণগত বৈশিষ্ট্য—এর মধ্য দিয়ে আমাদের জাতীয় জীবনের চরিত্র ও গুণগত পার্থক্য উঠে এসেছে। তার পরেও এই পরিচয় আমাদের, আমাদের ঐতিহ্য-অনুসন্ধানী গান, বাক জীবনের সুর, সর্বোপরি আত্মপরিচয়ের চিত্রসমষ্টি। এখানেই বাঙালি চিরঞ্জীব—চিরকালীন বাঙালিয়ানায়।

Share us

Leave a Reply

Your email address will not be published.